জাপানীদের সুস্বাস্থ্যের কিছু রহস্য

জাপানীদের সুস্বাস্থ্যের কিছু রহস্য

জাপানীদের সুস্থ থাকার রহস্য

জাপানীদের অধিকাংশই প্রবীণ। ২০২৫ সালের মধ্যেই জাপানের টোকিওতে তিন মিলিয়ন জনগণের বয়স ৬৫ অতিক্রম করবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই পরিসংখ্যানের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে জাপানিদের জন্মহার নিয়ন্ত্রন, যৌনতার প্রতি উদাসীনতা, যথাযথ জীবনধারণ, উন্নত স্বাস্থ্য কাঠামো। উল্লেখিত কারণগুলির মধ্যে যথাযথ জীবনধারণ পদ্ধতি কৌতূহলের জায়গা সৃষ্টি করে। কীভাবে জীবনধারণ করার মাধ্যমে সুস্থ থাকছে জাপানিরা, সত্যিই বিষয়টি জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে।

সুষম খাদ্য গ্রহণ

জাপানে খাদ্য তালিকা বৈচিত্র্যময় কিংবা অদ্ভুদ বললে ভুল হবে না। কম সিদ্ধ কিংবা কাঁচা রেখে রান্না করে খাওয়া জাপানী ঐতিহ্য। আমরা হয়তো মুখেই তুলতে পারবো না জাপানীদের প্রতিদিনকার রান্না করা খাবার। তবে মানুষ অভ্যাসের দাস। অভ্যাস করলে অসম্ভবপর নয় ব্যাপারটি।

ঐতিহ্যবাহী জাপানি ডায়েট পরিপূর্ণ হয় মাছ, সামুদ্রিক খাবার, শাক সবজি আর খুব সামান্য পরিমান প্রাণী প্রোটিন, চিনি ও ফ্যাট দ্বারা। নিউট্রিয়েন্টস পরিপূর্ণ এই খাদ্য অভ্যাস সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে পালন করে অবিশ্বাস্য ভূমিকা। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও হজম শক্তি বাড়াতেও জুড়ি নেই এই ডায়েটের।তবে খাদ্য তালিকা নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে দেখলাম জাপানিরা প্রক্রিয়াজাত খাবারে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য আর আমরা ঠিক উল্টো।

জাপানি ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকাতে থাকে স্টিমড রাইস (বাষ্প দিয়ে তৈরি ভাত), নুডুলস, টাটকা ফলমূল, তফু, শাকসবজি আর সাথে সামান্য পরিমানে মাংস, দুগ্ধ জাতীয় খাবার, ডিম। তবে জাপানের নাগানো অঞ্চলের লোকজন প্রত্যেকবেলাই সূপ রাখে তাদের খাবার মেন্যুতে। পরিমিত এই খাদ্য অভ্যাস জাপানিদেরকে সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে দারুণ ভূমিকা রাখে। জাপানিরা গ্রিন টি পান করে নিয়মিত। আর এই গ্রিন টী হচ্ছে অন্যতম স্বাস্থ্যকর পানীয় যা পলিফেনল অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট দ্বারা পরিপূর্ণ। গ্রিন টী ইনফ্লেমেশন কমিয়ে কোষকে দুরারোগ্য রোগের সাথে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।

জাপানীদের সুস্বাস্থ্যের কিছু রহস্য

জাপানে হৃদরোগের হার খুব কম। এর পিছনে রয়েছে সামুদ্রিক খাবারের ভূমিকা। প্রতিদিনকার জাপানি ডায়েটে থাকে প্রায় ৮৫ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার (সি ফুড)। আমরা একদমই সামুদ্রিক উদ্ভিদ (সি উইড) সম্পর্কে পরিচিত নই। তবে ভোজ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদে রয়েছে নিউট্রিয়েন্টস, মিনারেল, ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, প্রোটিন, ওমেগা ৩ ফ্যাট। জাপানে খাদ্য তালিকাতে সামুদ্রিক উদ্ভিদ থাকেই। যারা থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য ভোজ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদ খুবই কার্যকর। সামুদ্রিক উদ্ভিদগুলো মিনারেল আর ভিটামিনের উৎস হিসেবে রাখে দারুন ভূমিকা। হৃদরোগ হ্রাসে আর ওজন কমাতে কার্যকর উপাদান হিসেবে কাজ করে সামুদ্রিক উদ্ভিদ। সামুদ্রিক উদ্ভিদের মধ্যে থাকা ভিটামিন বি, ভিটামিন কে, জিংক আর তার সাথে  অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট  কোষের ধ্বংস মোকাবেলায় সাহায্য করে।

tea 1869716 960 720

জাপানে প্রচলিত আরেকটি জনপ্রিয় ডায়েটের নাম হচ্ছে ওকিনাওয়া ডায়েট। বেশি পরিমানে কার্বোহাইড্রেটের সাথে অল্প পরিমানে ফ্যাট আর ক্যালরির সমন্বয়ে হয় ওকিনাওয়া ডায়েট। ওকিনাওয়া ডায়েটে থাকে সয়াবিন, আস্ত শস্যদানা এবং বাদামের প্রাধান্য। আরেকটি দারুন ব্যাপার হচ্ছে তারা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করে।

সব চেয়ে মজার ব্যাপার জাপানীদের ৮০ ভাগের নিয়ম অনুসরন করে চলে। ৮০ ভাগের নিয়ম হচ্ছে খাওয়ার সময় আপনি যখন চিন্তা করবেন আপনার পেট ৮০ ভাগ ভর্তি তখনই খাওয়া শেষ করে দিবেন। সাধারনত আমরা সব সময়ই চাই পেট ১০০ ভাগ ফুল করে খাওয়া শেষ করার। এই ওকিনাওয়া অঞ্চলের মানুষ ব্লু জোনের ভিতর পরে। আচ্ছা, ব্লু জোন ধরা হয় সেই সকল অঞ্চলকে যেখানে অধিকাংশ মানুষজন দীর্ঘায়ুর হয়ে থাকে। এই ব্লু জোনের মানুষদের অভ্যাসগুলির মধ্যে আরেকটি অভ্যাস হচ্ছে পরিমিত ঘুম।

জাপানিজ ডায়েট পরিবর্তন হয়েছে বিগত শতকে। ১৯৭৫ সাল থেকে চলে আসা এই পরিবর্তনশীল ডায়েটকে ১৯৭৫ ডায়েট বলা হয়ে থাকে। তবে কার্যকরী এই ডায়েটে আছে কিছু নিজস্ব সতন্ত্র।  ডায়েটে থাকে অনেকগুলি ছোট আকারের ডিশ।  রান্নার নিয়ম হচ্ছে হাল্কা আঁচে, বাষ্প করে রান্না করা যেখানে একটু কাঁচা ভাব থাকে। খুব তেলে ভাজা এড়িয়ে যায় জাপানিজরা। জাপানিজরা একবারে বেশি খায় না। তবে অল্প করে দিনে কয়েকবার খায়। এতে করে হজম করার সময় পায় পরিপাকতন্ত্র।

জাপানে অঞ্চলভেদে ডায়েটে রয়েছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। তবে পরিবর্তন যাই হোক না কেন, জাপানীদের ডায়েটে সয় জাতীয় খাবার, শাকসবজি, বাদাম, ফলমূল, সামুদ্রিক মাছ এবং উদ্ভিদের প্রাধান্য থাকেই।

‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’ নীতি

আমাদের দেশের প্রতিকারে বিশ্বাসী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মানুষকে অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টাসিড আর এনএসএআইডির উপর এতোটাই নির্ভরযোগ্য করে ফেলেছে যেখানে সাধারণ জনগণ সাময়িক কষ্ট মুক্তির আশায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দিন দিন। অপরদিকে জাপানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ‘প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম’ নীতি অনুসরণ করে আসছে। ওষুধের উপর পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে তারা তাদের প্রাচীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। 

ব্যায়াম আর ব্যায়াম

জাপানিদের সম্পর্কে চিন্তাহীনভাবে বাঁধাধরা সাধারণ ধারণা গুলির মধ্যে অন্যতম জাপানিদের কর্মঠ জীবনযাপন। সাধারণত জাপানিরা অনেক পরিশ্রমী হয়ে থাকে। আমি এখানে শারীরিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বলছি। জাপানে সামাজিক উন্নয়ন সংস্থাগুলি নানাভাবে তাদের জনগণদের হাঁটতে উদ্ভুদ্ধ করে। বয়স্ক জনগণরা অংশগ্রহন করে এই ধরনের প্রোজেক্ট কিংবা আয়োজনে। আর এমনিতেও জাপানি বয়স্কদের রয়েছে পুরানো হাঁটার অভ্যাস। শারীরিক পরিশ্রম করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সাইক্লিং। মেট্রো রেল থেকে নেমেই কেউ হাঁটতে থাকে কিংবা সাইক্লিং করে বাসায় পৌছায়।
আরেকটি অবিশ্বাসও প্র্যাকটিস হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে ব্যায়াম করার সুযোগ। সুযোগ বললে ভুল হবে হয়তো, বলা যেতে পারে নিত্যদিনের নিয়ম। জাপানে অনেক কোম্পানি প্রতিদিন সকালে রাজিও তাইস (Rajio Taisou) করতে উৎসাহিত করে। রাজিও তাইসর আরেক নাম হচ্ছে রেডিও এক্সারসাইজ যেখানে প্রতিদিন একটি রেডিওর সাহায্যে কর্মীরা ব্যায়ামের নিয়মকানুন অনুসরণ করে ব্যায়াম করে। মাত্র ৪-৫ মিনিটের এই ব্যায়ামও এক ধরনের পজিটিভ প্রভাব ফেলতে পারে।
অবসরে যাওয়ার পরপরেই আমাদের দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের ব্যায়াম বিমুখ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায় যেখানে তাদের শারীরিক ব্যায়াম সবচাইতে জরুরী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে। আর এই দিকেও জাপানি বয়স্করা খুব সতর্ক! শহরের ফিটনেস ক্লাবগুলিতে দেখা যায় বয়স্কদের ভিড়।

ইকিগাই

উপাদান ঠিক থাকলেও অনেক সময় সফলতা ঠিক ভাবে আসে না যদি না প্রক্রিয়া বা  নিয়মে থাকে ঘাটতি। বিশৃঙ্খলতা এনে দিতে পারে ধ্বংস বাকি সব কিছু ঠিক থাকার পরেও। আর এখানেই এক বাস্তবিক কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় ইকিগাই এর। ইকিগাই হচ্ছে একটি ধারণা যেখানে দেখানো হয় কীভাবে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বেঁচে থাকতে হয়।  আচ্ছা বলে নেই, জাপানিজ শব্দ ইকিগাই এর মানে। ইকি শব্দটির মানে হচ্ছে বাঁচা আর গাই হচ্ছে কারন। আমাদের মধ্যে কর্মব্যস্ততা এমন ভাবে কাজ করে যেখানে আমরা ভুলেই যাই আমরা এই পৃথিবীতে বাস করতে এসেছি। আর পরবর্তীতে অস্বাস্থ্যকর কর্মব্যস্ততা মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।

ইকিগাই হচ্ছে এই গতিশীলতা কমিয়ে অনুধাবনের একটি প্রক্রিয়া যেখানে জাপানিজরা সময় নিয়ে চিন্তা করে, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে, আর বেঁচে থাকার মানে বের করার চেষ্টা করে। এতে এক ধরনের পজিটিভ এনার্জি আসে। জীবনের উদ্দেশ্যের দিকে নজর পরে।  ইকিগাই স্বেচ্ছাসেবী কর্মকাণ্ডে জাপানিজদের উৎসাহিত করে আর যা সমাজের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য, পজিটিভিটি, তার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধিত হয়। 

জাপানীরা ভূমিকম্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা মোকাবেলা করার পরেও এক উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদেরকে সুপরিচিত করেছে বিশ্বদরবারে। শারীরিক সুস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে জাপানীদের এই ঐতিহ্য, জীবনধারণের নিয়ম সত্যিকার অর্থেই একটি অনুপ্রেরণার জায়গা। তেলে ভাঁজা প্রক্রিয়াজাত খাবারের বর্জন , শাকসবজির প্রতি আগ্রহ প্রকাশের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য থাকবার ইচ্ছা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে যেখানে আমরা একবারেই তেলে ভাঁজা প্রক্রিয়াজাত খাবারের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। আর জাপানের ফাস্টিং প্রথা যে শরীরের জন্য উপকারী তাতো বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত। আমরাও রোজা রাখতে পারি প্রতি সপ্তাহে যেখানে ধর্মীয় মুখ্য তাৎপর্য থাকার পাশাপাশি আছে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা।

তথ্য উৎসঃ
https://www.agewatch.net/secrets-of-longevity/japanese-longevity
www.healthline.com/nutrition/japanese-diet
www.healthline.com/nutrition/okinawa-diet#the-diet

 

About ফাহাদ মজুমদার

Check Also

আমস্টারডামে ইসরায়েলি ফুটবল ভক্তদের সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের সংঘর্ষ

আমস্টারডামের সিটি কাউন্সিলের একজন সদস্য বলেছেন, ‘মাকাবি হুলিগানরাই’ প্রথমে সহিংসতার সূচনা করে এবং ফিলিস্তিনপন্থী সমর্থকদের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *