ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হলে করণীয়? - কখন ডাক্তারের কাছে নিতে হবে? দ্রুত আরোগ্যের সেরা গাইড

ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হলে করণীয়? – কখন ডাক্তারের কাছে নিতে হবে? দ্রুত আরোগ্যের সেরা গাইড

পাতলা পায়খানা: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও ঘরোয়া প্রতিকার – সম্পূর্ণ গাইড

 

পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে গুরুতর হতে পারে। এই নির্দেশিকায় আমরা পাতলা পায়খানার কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং কার্যকর ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পাতলা পায়খানা কী? (What is Diarrhea?)

পাতলা পায়খানা, যা ডায়রিয়া নামেও পরিচিত, হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি দিনে তিন বা তার বেশি বার অস্বাভাবিক রকমের তরল বা আধা-তরল মল ত্যাগ করেন। এটি সাধারণত অল্প সময়ের জন্য থাকে, তবে কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং শরীরের পানি ও লবণ হারানোর কারণে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

পাতলা পায়খানার কারণ (Causes of Diarrhea)

পাতলা পায়খানার অনেক কারণ থাকতে পারে। এদের মধ্যে প্রধান কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:

  • সংক্রমণ:
    • ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ: ই. কোলাই, সালমোনেলা, ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার, শিগেলা ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে পাতলা পায়খানা হতে পারে। দূষিত খাবার বা পানি থেকে এই সংক্রমণ ছড়ায়।
    • ভাইরাল সংক্রমণ: রোটাভাইরাস, নোরোভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস ইত্যাদি ভাইরাস শিশুদের এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রধান কারণ।
    • পরজীবী সংক্রমণ: জিয়ার্ডিয়া ল্যাম্বলিয়া, ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম ইত্যাদি পরজীবী দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
  • খাদ্য ও পানীয়:
    • দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা (ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স)।
    • কিছু ফল বা সবজি অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া।
    • কৃত্রিম মিষ্টি (যেমন সরবিটোল, ম্যানিটোল) বেশি গ্রহণ।
    • অস্বাস্থ্যকর বা পচা খাবার খাওয়া।
  • ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:
    • অ্যান্টিবায়োটিক (এন্টিবায়োটিক ভালো ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলে, যা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করে)।
    • ক্যান্সারের কেমোথেরাপি ঔষধ।
    • কিছু অ্যান্টাসিড।
  • অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্যগত সমস্যা:
    • ক্রোন’স ডিজিজ বা আলসারেটিভ কোলাইটিস (প্রদাহজনিত অন্ত্রের রোগ)।
    • ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS)।
    • সিলিয়াক ডিজিজ।
    • ডায়াবেটিস।
    • হাইপারথাইরয়েডিজম।
  • অন্যান্য কারণ:
    • মানসিক চাপ বা উদ্বেগ।
    • অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া।
    • অস্ত্রোপচার, বিশেষ করে গ্যাস্ট্রিক বা অন্ত্রের অস্ত্রোপচার।

পাতলা পায়খানার লক্ষণ (Symptoms of Diarrhea)

পাতলা পায়খানার প্রধান লক্ষণ হলো ঘন ঘন তরল মল ত্যাগ। এর সাথে অন্যান্য যেসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে, সেগুলো হলো:

  • পেটে ব্যথা ও মোচড়ানো।
  • বমি বমি ভাব বা বমি।
  • পেটে গ্যাস বা ফাপা অনুভব।
  • জ্বর।
  • মাথাব্যথা।
  • ক্ষুধামন্দা।
  • তৃষ্ণা বৃদ্ধি (পানি স্বল্পতার কারণে)।
  • দুর্বলতা ও ক্লান্তি।
  • গুরুতর ক্ষেত্রে মলের সাথে রক্ত বা শ্লেষ্মা।

পাতলা পায়খানা হলে করণীয় ও ঘরোয়া প্রতিকার (What to Do for Diarrhea & Home Remedies)

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা কয়েক দিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে কিছু ঘরোয়া উপায় এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন লক্ষণ কমাতে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করতে পারে:

১. পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ (Fluid Intake):

পাতলা পায়খানার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো পানিশূন্যতা। তাই প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা অত্যন্ত জরুরি।

  • ওআরএস (ORS): খাওয়ার স্যালাইন হলো পানিশূন্যতা পূরণের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমোদিত ওআরএস ব্যবহার করুন।
  • ডাবের পানি: এতে প্রাকৃতিক ইলেক্ট্রোলাইট থাকে যা শরীরের খনিজ লবণ পূরণ করতে সাহায্য করে।
  • স্যুপ বা চিকেন ব্রোথ: এতে থাকা লবণ এবং পুষ্টি শরীরকে শক্তি যোগায়।
  • ফলের রস (পাতলা করে): আপেলের রস বা কলার রস পান করতে পারেন, তবে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত রস এড়িয়ে চলুন।
  • চা: আদা চা বা পুদিনা চা হজমে সাহায্য করতে পারে।

২. সঠিক খাবার গ্রহণ (Appropriate Diet):

ডায়রিয়া হলে হজম সহজ হয় এমন খাবার খাওয়া উচিত।

  • কলা: পটাশিয়ামের ভালো উৎস এবং সহজে হজম হয়।
  • চাল: সাদা ভাত বা ভাতের মাড় ডায়রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
  • সেদ্ধ আলু: সহজে হজমযোগ্য এবং শক্তি যোগায়।
  • টোস্ট বা বিস্কুট: হালকা এবং হজমে সহায়ক।
  • দই: প্রোবায়োটিক থাকে যা অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তবে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকলে এড়িয়ে চলুন।
  • ডিম: সেদ্ধ ডিম বা নরম করে রান্না করা ডিম।

এড়িয়ে চলুন: চর্বিযুক্ত খাবার, ভাজা পোড়া, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য (যদি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকে), অতিরিক্ত মশলাদার খাবার, কাঁচা ফল ও সবজি, ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল।

৩. বিশ্রাম (Rest):

শরীরকে সুস্থ হতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন।

৪. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা (Hygiene):

সংক্রমণ ছড়ানো রোধ করতে নিয়মিত হাত ধোয়া জরুরি, বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর এবং খাবার প্রস্তুত করার আগে ও পরে।

শিশুদের পাতলা পায়খানা (Diarrhea in Children)

শিশুদের পাতলা পায়খানা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বেশি গুরুতর হতে পারে কারণ তারা দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে।

  • ওআরএস: শিশুর বয়স অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ওআরএস দিন। ছোট চুমুকে বারবার খাওয়ান।
  • মায়ের দুধ: বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যান। এটি পানিশূন্যতা রোধে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করে।
  • জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের পাতলা পায়খানা চিকিৎসায় ১০-১৪ দিনের জন্য জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট সুপারিশ করে।
  • কখন ডাক্তার দেখাবেন: যদি শিশুর জ্বর থাকে, মলের সাথে রক্ত বা শ্লেষ্মা যায়, পানিশূন্যতার লক্ষণ (কম প্রস্রাব, চোখ বসে যাওয়া, শুষ্ক মুখ) দেখা যায়, বা পাতলা পায়খানা ২৪ ঘণ্টার বেশি স্থায়ী হয়, অবিলম্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

গর্ভবতী মায়ের পাতলা পায়খানা (Diarrhea in Pregnant Women)

গর্ভাবস্থায় পাতলা পায়খানা হলে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।

  • পানিশূন্যতা এড়ান: পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল, বিশেষ করে ওআরএস পান করুন।
  • হালকা খাবার: সেদ্ধ ভাত, কলা, টোস্টের মতো হালকা খাবার খান।
  • ডাক্তারের পরামর্শ: গর্ভাবস্থায় কোনো ঔষধ সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। যদি পাতলা পায়খানা গুরুতর হয়, জ্বর থাকে, বা মলের সাথে রক্ত যায়, দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন (When to See a Doctor)

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা বাড়িতেই ঠিক হয়ে যায়, তবে কিছু পরিস্থিতিতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি:

  • ২ দিনের বেশি পাতলা পায়খানা স্থায়ী হলে (শিশুদের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার বেশি)।
  • তীব্র পেটে ব্যথা বা মোচড়ানো।
  • ১০২° ফারেনহাইট (৩৮.৯° সেলসিয়াস) বা তার বেশি জ্বর।
  • মলের সাথে রক্ত বা কালো আলকাতরার মতো মল।
  • তীব্র পানিশূন্যতার লক্ষণ (যেমন: অতিরিক্ত তৃষ্ণা, কম প্রস্রাব, মাথা ঘোরা, শুকনো মুখ, দুর্বলতা, চোখ বসে যাওয়া)।
  • যদি আপনি গর্ভবতী হন, বয়স্ক হন, বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে।

পাতলা পায়খানা প্রতিরোধে করণীয় (Prevention of Diarrhea)

পাতলা পায়খানা প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ ধাপ অনুসরণ করা যেতে পারে:

  1. পরিষ্কার পানীয় জল: বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পান করুন। প্রয়োজন হলে পানি ফুটিয়ে পান করুন।
  2. খাদ্য সুরক্ষা:
    • খাবার ভালোভাবে রান্না করুন।
    • রান্না করা খাবার ও কাঁচা খাবার আলাদা রাখুন।
    • খাবার খোলা রাখবেন না, ঢেকে রাখুন।
    • বাইরের খোলা বা অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে চলুন।
  3. হাত ধোয়া: সাবান ও পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধুন, বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর, খাবার তৈরির আগে ও পরে এবং খাওয়ার আগে।
  4. ফলের ও সবজির পরিচ্ছন্নতা: ফল ও সবজি খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিন।
  5. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা: ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
  6. ভ্রমণে সতর্কতা: অপরিচিত জায়গায় ভ্রমণের সময় বোতলজাত পানি পান করুন এবং কাঁচা সালাদ বা রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলুন।

About ফাহাদ মজুমদার

Check Also

বাতের ব্যথার আধুনিক চিকিৎসা

বাতের ব্যথার আধুনিক চিকিৎসা বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের উন্নত ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। চিকিৎসার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *